প্রকৃতির জোম্বিরা

আপন মনে ঘুরে বেড়ানো নেংটি ইঁদুর। ছোট একটি প্রাণীর ছোট একটি মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্কে চলে সরল সহজ কিছু চিন্তা, তার একটি হলো আশেপাশে প্রাণঘাতী বিড়ালের অবস্থান বিষয়ে সতর্ক থাকা।

“আচ্ছা, কিছু রোম পড়ে আছে, শুঁকে দেখা যাক! ওহ শিট, এ-তো বিড়ালের গন্ধ! পালাই পালাই!”

“ওখানটা অমন চটচটে হয়ে আছে কেন? এঁটো খাবার দাবার আছে নাকি কিছু? একি, বেড়ালের পেচ্ছাব! ভাগো, ভাগো!”

এই গৎবাঁধা হিসাব নিকাশ এলোমেলো হয়ে যায় কদাচিৎ কোন কোন রোগে। এই সদা সতর্ক নেংটি ইঁদুরের বিড়ালকে আর ভয়ংকর মনে হয় না তখন, বিড়ালের পেচ্ছাবের গন্ধ তার নাকে লাগে সুধার মতো।

অন্য ইঁদুরেরা সন্ত্রস্ত হয়ে দেখে, এই “পাগল” ইঁদুর নির্বিকার হেঁটে বেড়ায় বিড়ালের উপস্থিতি উপেক্ষা করে। বেশিরভাগ সময় এই রোগগ্রস্ত ইঁদুরের মৃত্যু হয় বিড়ালের শিকার হয়ে।

ইঁদুরের এই কালান্তক রোগের জীবাণুর নাম, টক্সোপ্লাজমা গোত্রের এককোষী একটা প্রাণী। টক্সোপ্লাজমা বাস করে বিড়ালের পরিপাকনালীতে পরজীবী হিসাবে। এদের সিস্ট নির্গত হয় বিড়ালের মলের সাথে। এখন পরবর্তী প্রজন্ম পরিণত হতে মল থেকে আবার বিড়ালের পেটে ঢুকতে হবে। এখানেই আসে ইঁদুরের ভূমিকা। কোনভাবে বিড়ালের মল থেকে এরা চলে আসে ইঁদুরের শরীরে (ময়লা ঘাঁটাঘাঁটি করে জীবন পার করা ইঁদুর খুব সহজেই আক্রান্ত হয় বিড়ালের মল থেকে)।

ইঁদুরের শরীরে ঢুকে টক্সোপাজমার শরীর থেকে নিঃসরিত হয় কিছু নিউরো-কেমিক্যাল। আমাদের স্নায়ুতন্ত্র তথা মস্তিষ্ক “ইন্টারনাল” যোগাযোগের জন্য কিছু নিউরোট্রান্সমিটার কেমিক্যালের উপর নির্ভরশীল। আমাদের ভয়, আনন্দ, পুলক, স্নেহ, ক্ষোভ- সব অনুভূতি “অনুভর”-এর পেছনে ভূমিকা রাখে কোন না কোন নিউরোট্রান্সমিটার। টক্সোপ্লাজমার শরীর নির্গত কেমিক্যাল ইঁদুরের মস্তিষ্কের এই নিউরোট্রান্সমিটারের হিসাব নিকাশ পালটে দেয়। বিড়ালের প্রস্রাবের গন্ধ যখন ইঁদুরের মস্তিষ্ককে প্রাণভয়ে ভীত করে তোলার কথা, তখন সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে তার ভালো লাগতে থাকে। বলা যায়, আমাদের বিবেচনায় ইঁদুরটা “পাগল” হয়ে যায়।

কিংবা, টক্সোপাজমার আবার বিড়ালের পেটে প্রবেশের জন্য ইঁদুরটা ব্যবহৃত হয় এক “জোম্বি” হিসাবে।

আমাদের শরীরে ম্যালেরিয়া ঘটায় যে “প্লাজমোডিয়াম” জীবাণু, তারা বেচারা মশাকে নিয়ে রীতিমতো নাকানিচুবানি খাওয়ায়। মশার দেহে প্লাজমোডিয়াম যখন বাড়ন্ত অবস্থায় থাকে, মশার তখন মানুষের রক্তে অরুচি হয়, তার কেবল বিভিন্ন ফুলের মিষ্টি মধু খেতে ভালো লাগে। প্লাজমোডিয়ামের বাড়ন্ত শরীরের কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা মেটাতে মশা বেচারা রক্ত বাদ দিয়ে ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়। এরপর যখন প্লাজমোডিয়াম জীবণু প্রস্তুত হয় গরম রক্তের প্রাণীর দেহে প্রবেশ করার জন্য, মশার তখন আবার রক্তের রুচি ফিরে আসে, আর কোন এক দুর্ভাগা স্তন্যপায়ীকে কামড়ে প্লাজমোডিয়ামের জীবনচক্র পূরণে সাহায্য করে।

আরেকধরণের পাখির কৃমি আছে, যাদের ডিম মলের সাথে নির্গত হয়, যা আবার খাবারের সাথে চলে যায় শামুকের পেটে। এই শামুকেরা দিনের বেলায় পাথরের তলায় লুকিয়ে থাকে আর রাতের বেলা খাবারের জন্য বের হয়। কিন্তু এই কৃমির লার্ভা শামুকের রুটিন পালটে দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে খাওয়া দাওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। ফলে বেচারা শামুক পাখির সহজ শিকারে পরিণত হয়, আর কৃমিও চলে আসে তার ঠিকানায়- পাখির পেটে।

প্রাণীদের মস্তিষ্কের কাজ-কর্ম, চিন্তাভাবনা, অনুভূতির পেছনে নিউরোট্রান্সমিটারের নির্ভরতার সুযোগ নিয়ে কোন পরজীবীর তাকে “জোম্বি”তে পরিণত করার এগুলোই কেবল উদাহারণ নয়। এরকম শত-শত উদাহারণ মানুষের জানা, আর মানুষ এখনও আবিষ্কার করতে পারে নাই, এরকম থাকার কথা অন্তত কয়েক হাজার।

এখন প্রশ্ন হলো, মানুষের কি এমন কোন পরজীবীর সংক্রমণ হয়, যা তাকে জোম্বি করে ফেলতে পারে?

উত্তর হলো, হ্যাঁ, এটা সম্ভব। কারণ মানুষের মস্তিষ্কও নিউরোট্রান্সমিটারের উপর নির্ভরশীল।

জলাতঙ্ক রোগ এটার একটা সরাসরি উদাহারণ। প্রথম উদাহারণের টক্সোপ্লাজমা ইঁদুরের পাশাপাশি মানুষকেও আক্রমণ করতে পারে, মানুষের সিজোফ্রেনিয়া রোগের পেছনে এই জীবাণুর ভূমিকা এখন বেশ স্বীকৃত; কেউ কেউ ধারণা করে মানুষের বিড়াল-প্রেমের পেছনেও এই জীবাণুর ভূমিকা থাকতে পারে।

জীবাণু নয়, মানুষ জোম্বিতের পরিণত হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে আছে খোদ মানুষের হাতে। ড্রাগ এডিক্টরা যে ড্রাগ নেয়, তার অনেককয়টিই মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের কাজ কর্মে একটা ঝাঁকি দেয়, যে কারণে এদের থেকে পুলক পায় ব্যবহারকারী। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে সম্ভব যে, এরকম কোন ড্রাগ বানানো, যা কাউকে সেবন করিয়ে দিলে, তাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বাইরে থেকে। নিয়ন্ত্রণ বলতে তার সমস্ত চিন্তা-ভাবনা, ইচ্ছা, ভালোবাসা, ক্রোধ- সবকিছু নিয়ন্ত্রণ। জিনিসটা যে ড্রাগ হতে হবে, তার কোন কথা নেই, হতে পারে অতি ক্ষুদ্র কোন মাইক্রোচিপ, যা কারও অজান্তে তার দেহে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যায়।

এধরণের কিছু বানানো উচিত কি অনুচিত, সেটা আলাপযোগ্য, কিন্তু এটা করা সম্ভব। জোম্বি এপোকেলিপ্সকে অবাস্তব বলে হেসে উড়িয়ে দেওয়া সহজ, কিন্তু মানবসৃষ্ট মানবজোম্বির অস্তিত্ব এখন সক্ষমতার প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন নৈতিকতার। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *