ইউরিয়া ও তদসংশিষ্ট কিছু বিক্ষিপ্ত বয়ান

ক্লাস নাইন-টেনের কেমিস্ট্রি বইয়ের শেষদিকে ছিলো জৈব রসায়নের একটা অধ্যায়। সেখানে খটমটে নামের এক জার্মান বিজ্ঞানী, ফ্রেডরিক ভোলার-এর অ্যামোনিয়াম সায়ানেট থেকে ইউরিয়া বানানোর একটা ঘটনা ছিলো। ১৮২৮ সালের এই বিক্রিয়াটা ছিলো যুগান্তকারী। কারণ এই প্রথম মানুষ “প্রাণশক্তি”র সাহায্য ছাড়াই কোন জৈব যৌগ ল্যাবরেটরিতে খটর-মটর করে বানিয়ে ফেলে। এর আগে, ইউরিয়া (এবং আরও সকল জৈব যৌগ) শুধু জীবদেহেই তৈরি হতে পারে বলে ভাবতো মানুষ। ভোলারের এই কীর্তির পরে একে একে খুলতে থাকে জৈব রসায়নের রহস্যের দরজা।

Friedrich Wöhler

তবে একটা জিজ্ঞাসার উত্তর আরও কঠিন (আমার ব্যক্তিগত একটি কৌতূহল), ১৮২৮ সালে মানুষ ল্যাবে প্রথম যে ইউরিয়া তৈরি করে; এই ইউরিয়া জীবদেহে প্রথম উৎপত্তি হয় কবে থেকে?

স্কুলে থাকতে মাঝে মধ্যে দৌড়-ঝাপ-খেলাধুলা করে তলপেটে ব্যথা করতো, তখন মনে পড়তো পানি খাওয়া হয় নাই সারাদিন। এক বন্ধুকে কল চাপতে বলে পেট ভরে পানি খেতাম কলের মুখ থেকে, এরপর একটু হাত পা ঝাড়া দিলেই সব ঠিকঠাক।

এই পানি, অপর নাম যার জীবন; আমার থেকে একটি কলের মাত্র দূরত্ব যার- কারও জন্য এই পানি আবার বড় দুষ্প্রাপ্য। মরুভূমির বালুতে ঘুরে বেড়ানো গিরিগিটি হয়তো কখনোই তরল রূপে পানি পান না করে জীবন কাটিয়ে দেয়, সারা রাতে জমা হওয়া শিশির কণাই তার অবলম্বন। আবার কেউ কেউ, যেমন বেশিরভাগ মাছ, পানি ছাড়া পারিপার্শ্বিক তার কখনও নাই। স্বাভাবিকভাবেই পানির সাথে এদের, আমাদের সম্পর্ক; পানির ব্যবহার ভিন্ন রকম।

আমাদের শরীরে উৎপন্ন ইউরিয়ার উৎস হলো আমাদের খাবারের নাইট্রোজেন। আমাদের খাবারে প্রচুর নাইট্রোজেন, আমাদের যতোটুকু দরকার, তার থেকে অনেক বেশি। এই বাড়তি নাইট্রোজেন শরীরে ঘুরে বেড়ানো হাইড্রোজেনের সাথে বিক্রিয়া করে উৎপাদন করে বিষাক্ত অ্যামোনিয়া। অ্যামোনিয়া শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর, তাই সব প্রাণীর শরীরের একটা ডেডিকেটেড সিস্টেম থাকে এই অ্যামোনিয়া বের করে দেওয়ার জন্য (রেচন তন্ত্র)।

মাছদের জন্য ব্যাপারটা খুব সহজ, যেহেতু অ্যামোনিয়া পানিতে দ্রবণীয়, তারা খুব সহজেই ফুলকা দিয়ে অ্যামোনিয়া পানিতে ধুয়ে দেয়। কিন্তু আমরা যারা ডাঙার বাসিন্দা, সব অ্যামোনিয়াকে পানিতে দ্রবীভূত করে বের করে দিতে আমাদের প্রতিদিন কয়েক গ্যালন করে মূত্র ত্যাগ করতে হতো। এতো পানি তো ছেলেখেলা নয়, তাই ডাঙায় বাস করতে প্রয়োজন রেচন তন্ত্রের বাড়তি অভিযোজন। আমাদের শরীরের ভেতরের কলকব্জা অ্যামোনিয়াকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাথে রান্না করে তৈরি করে ইউরিয়া। ঘটনাটা ঘটে মূলত আমাদের যকৃতে, তারপর এই ইউরিয়াগুলো কিডনীতে ফিল্টার হয়ে জমা হয় মূত্রথলিতে। আমরা নাহয় নিয়মিত পানি খাই, তাই দিনে বারকয়েক মূত্রত্যাগ কোন ব্যাপার না; কিন্তু মরুভূমিতে বাস করে পেশাব করা বিলাসিতা বৈকি। মরুভূমির প্রাণীরা, প্রধানত সরিসৃপ আর পাখি, তারা রেচন তন্ত্রকে নিয়ে গেছে আরেক লেভেল উচ্চতায়। তারা ইউরিয়া বানিয়েই ক্ষান্ত হয় না, একে আবার ইউরিক এসিডে রূপান্তর করে, যা নির্গত হয় পেস্ট কিংবা পানিশূণ্য পাওডার হিসাবে।

যাই হোক, আমার কৌতূহল ছিলো জীবদেহে ইউরিয়া উৎপাদন শুরু হয় কবে থেকে? খুব স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, উত্তরটা সঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়। তবে আমাদের শরীরে যে অভিযোজন থেকে ইউরিয়া উৎপাদন হয়, এই অভিযোজন যে সাড়ে তিনশ মিলিয়ন বছরের চেয়ে বেশি পুরোনো, এখন বিজ্ঞানীরা মোটামুটি সে বিষয়ে নিশ্চিত। যাই হোক, কৌতূহল কোন রকম নিবৃত্ত হলো, তবে বিষয়টা যেহেতু মজার, তাই আরেকটু সামনে এগুনো যাক।

মাছেরা যে কারণে ইউরিয়া উৎপাদন করে না (কারণ চারদিকে পানির সমারোহ), সেই যুক্তিতে ধরে নেওয়া যায় পানিবাসী প্রাণিরা কেউ ইউরিয়া উৎপাদন করবে না। কারণ অ্যামোনিয়া পানিতে ধুয়ে দেওয়া খুব সহজ, যেখানে ইউরিয়া উৎপাদন হয় ইউরিয়া চক্র নামের এক resource hungry প্রক্রিয়ায়। কিন্তু জলচর অনেক প্রাণীর শরীরে ইউরিয়া উৎপাদন হয়।

ডলফিন, তিমি এসব স্তন্যপায়ী প্রাণীরা লিস্টে স্বাভাবিকভাবেই আসবে, এরা তো আমাদের জ্ঞাতিভাই, কাজেই আমাদের মতো রেচনতন্ত্র এদের থাকারই কথা; আছেও। তবে কিছু জীবন্ত জীবাস্ম মাছ (যেমন কোয়ালাকান্থ) শরীরে ইউরিয়া তৈরি করে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হাঙর জাতীয় মাছের।

এমনিতে সামুদ্রিক মাছের লবণাক্ততা মানিয়ে নিতে শরীরের বেশ কিছু কলকব্জা ব্যস্ত থাকে। লবণাক্ততা প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর, কারণ পানি আর লবণের কম্বিনেশন মানেই চার্জিত আয়নের সমারোহ। আবার প্রাণীদের স্নায়ুতন্ত্র কাজ করে আয়নিক চার্জের নীতির উপর ভিত্তি করে। তাই শরীরে অতিরিক্ত লবণ সামুদ্রিক প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব রাখতে পারে, স্নায়ুতন্ত্র ওভারলোডেড হয়ে সিজার (খিঁচুনি) হতে পারে। তাই লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ সামুদ্রিক মাছেদের একটা প্রধান শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া।

এদিকে ইউরিয়ার দ্রবণ আবার লবণাক্ত, কিন্তু এতে কোন স্নায়ু বিনাশী চার্জিত আয়ন নাই। হাঙর জাতীয় মাছেরা এই সুযোগটাই নেয়। এদের রেচনতন্ত্র থেকে ইউরিয়ার অনেকাংশ রক্তে চলে আসে। রক্তকে ইচ্ছাকৃতভাবে আংশিক দূষিত করে এদের দেহে বাড়তি লবণের প্রবেশ ঠেকিয়ে দেয় এরা। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার এর চেয়ে ভালো উদাহারণ কী হতে পারে?

পুনশ্চ ১ঃ যে ইউরিয়া চক্রের মাধ্যমে ইউরিয়া উৎপন্ন হয়, সেই চক্রের খুব কাছাকাছি বিক্রিয়াগুচ্ছ থেকে অ্যামিনো এসিড তৈরি হয়, যা জীবদেহের মৌলিক ভিত্তি। ধারণা করা হয় ইউরিয়া উৎপাদনের অভিযোজন অ্যামিনো এসিড তৈরির কোন এক জিনের মিউটেশন থেকে হয়েছে।

পুনশ্চ ২ঃ একটা বেশ স্বীকৃত তত্ত্ব হচ্ছে, ইউরিয়া তৈরির অভিযোজন প্রথমে হয় সামুদ্রিক প্রাণীতে, লবণাক্ততা মোকাবিলার অস্ত্র হিসাবে৷ রেচন তন্ত্রে এর ভূমিকা আসে “সাইড ইফেক্ট” হিসাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *